মাওলানা ইয়াকুব সাহেবের চিঠি। ২০১৬ সালে লিখেছিলেন। সাদ সাহেবের হাজারটা ভুলের লিষ্ট করার থেকে এই একটা চিঠি অনেক গভিরে গিয়ে অনেক কিছু বুঝায়। কি সমস্যা? কোন পক্ষ হক?
এটা আমি আগে পড়ি নি, এখন পড়ছি। বা তখন পড়লেও বুঝতে পারি নি। এখন যত ভালো ভাবে বুঝতে পারছি এর পরিনতি দেখে।
paste ______
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম।
দাওয়াতের সাথীদের উদ্দেশে কিছু কথা
নিযামুদ্দিনে আমি প্রায় ১৫ বছর হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ সাহেব রহ. এর সঙ্গে থেকেছি। তাঁর ইনতিকালের পর প্রায় ৩০ বছর মাওলানা ইনআমুল হাসান সাহেব রহ. এর সঙ্গে থেকেছি। প্রায় ৫০ বছরের এই দীর্ঘ সময়ে তাঁদের দু’জনকে খুব কাছ থেকে দেখার ও দেশে-বিদেশে সঙ্গে থাকার সুযোগ মহান আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন।
এ দু-হযরাতের নির্দেশনা, পথপ্রদর্শন ও তত্ত্বাবধানে এই মহান ও উঁচু কাজ করার সৌভাগ্য আল্লাহ তাআলা আমাকে দিয়েছেন। তার আলোকে আমি এ কথা পূর্ণ ঈমানদারির সঙ্গে নিবেদন করছি যে, তাবলীগের এই মেহনতকে উপর্যুক্ত হযরতগণ রহ. যে পদ্ধতির ওপর রেখে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে সরে গেছে এবং বিচ্যূত হয়েছে।
আমাদের এই দু’ মুরুব্বি যদিও সবার পূর্ণ সম্মতিতে ‘আমির’ মনোনীত হয়েছিলেন; কিন্তু তারা কখনই নেতৃত্বের দাবী তোলেননি।
কখনো নির্দেশের সুরে কথা বলেননি।
কখনো আমিত্ব জাহের করেননি। তাঁরা সবসময় নিজেদেরকে মাশওয়ারার অনুগত রাখতেন। তারা যখনই কোনো বিষয় চালু করতে চেয়েছেন, সাথীদের সবার সম্মতি নিয়েই করেছেন। আমির হওয়া সত্ত্বেও তারা সবসময় নিজেকে মাশওয়ারার অনুগত রেখেছেন।
কিন্তু এখন ওই চিত্র পুরোপুরি বদলে গেছে।
এখন নিজেকে আমির ঘোষণা করা হচ্ছে।
কেউ কোনো কথা মানতে না চাইলে তাকে তা মানতে নানাভাবে বাধ্য করা হচ্ছে। যার ফলে এখন নিযামুদ্দিন মারকায এতোটাই বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে যে, সেখানে গালি-গালাজ ও মারপিট পর্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
যেই নিযামুদ্দিন মারকায ছিলো উম্মতের ফিকির, নিজের ইসলাহ ও আখেরাত গুছানোর জায়গা, যে কেউ যেখানে এলে নিজের মাঝে উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করে নিয়ে যেতো, আজ নিযামুদ্দিনে সেই পরিবেশ নেই। এখানে নিযামুদ্দিন মারকাযের সর্বত্র গীবত, কুধারণা ও অপবাদ আরোপের হিড়িক চলছে। যারা এই মেহনতকে সঠিক পদ্ধতির ওপর বহাল রাখতে চাচ্ছে, নিযামুদ্দিন মারকায তাদেরকে পরাজিত করার নিত্য-নতুন কৌশল তৈরির প্রজননকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এমন পরিবেশে এখন যারা আসছে, তাদের সংশোধন তো পরের কথা, তারা আরো অধপতনের শিকার হচ্ছে। যার ফলে কাজের স্প্রিট নিঃশেষ হয়ে গেছে। সেখানে আগতদের মস্তিষ্কে এ খোরাক দেওয়া হচ্ছে যে, ‘অনুসরণ করলেই নাজাত পাবে (অনুসরণের শর্তে যা ইচ্ছে করতে পারো, কোনো সমস্যা নেই) কিন্তু যদি অনুসরণ না করো, কোনো কথার বিরোধিতা করো তাহলে নাজাত পাবে না, চাই তুমি যতোই মুখলিস হও, যতোই কুরবানি দাও।’
নিযামুদ্দিন মারকাযের পরিবেশে পূর্বে যেই নিজের ইসলাহের ফিকির ছিলো, আখেরাত সাজানোর ফিকির ছিলো, দ্বীনের প্রতি হৃদয়ের ব্যাথা-বেদনা ও উম্মাহর প্রতি সহমর্মিতার যেই অন্তর্জ্বালা ছিলো, এখন তা নিঃশেষ হয়ে গেছে। তার স্থানে এখন নিজের মত চাপিয়ে দেওয়া, মনের খায়েশমত নির্দেশ করা, দুনিয়ার প্রতি লোভ ও আমিত্ব ফলানোর পরিবেশ গড়ে উঠেছে। আর এই স্বার্থোদ্ধারের জন্যেই এখন ‘উমুমি বাইআত’ বা গণহারে বাইআত করানোর কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। অথচ হযরতজি রহ. কর্তৃক গঠিত শূরা সর্বসম্মতিক্রমে বাইআত করতে নিষেধ করেছিলেন। সেই লিখিত সিদ্ধান্তের ওপর হযরতজির শূরার সকল সদস্যের স্বাক্ষরও রয়েছে।অতীতের দু-হযরতের আমলে যেই নতুন নতুন উদ্ভাবিত বিষয়গুলো ছিলো না, এখন মাশওয়ারা ছাড়াই সেগুলো চালু করা হয়েছে।
এর একটি হল, ‘দাওয়াত, তালীম ও ইসতিকবাল’। নতুন এই পরিভাষা চালু করা হয়েছে। যা আমাদের আকাবির রহ. এর যুগে ছিলো না। যদিও ইদানিং এই পরিভাষার নাম পরিবর্তন করে ‘তামীরে মসজিদ’ নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু কাজ আগেরটাই। এই নতুন সিদ্ধান্তের ফলে প্রতিদিন ঘরে ঘরে গিয়ে মেহনত করা ও উমুমি গাশত করার গুরুত্ব পুরোপুরি লোপ পেয়েছে। দ্বিতীয় বিষয় হল, খাওয়াস ও অন্যান্য পদমর্যাদার লোকদের মাঝে মেহনত করা থেকে নিষেধ করা হচ্ছে। অথচ এ কাজ পূর্বের উভয় হযরতের যুগ থেকেই হয়ে আসছে। দেখা যেতো, পরবর্তীকালে খাওয়াস ও অন্যান্য পদমার্যাদার লোকজন উমুমি মেহনতের সঙ্গে জুড়ে যেতেন। এর উপকারিতা সূর্যালোকের চেয়েও স্পষ্ট। এই তবকাতি মেহনত বন্ধ করার জন্যে, ‘তামীরে মাসজিদ’ এর নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্যে শরিয়তের বিভিন্ন নস (نص) এর অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
তৃতীয় বিষয় হল, মুনতাখাব হাদীস। মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ রহ. কখনো ইঙ্গিতেও এই কিতাব তালীম করার কথা বলেননি। এখন ধীরে ধীরে ‘ফাযায়েল আমাল’ উঠিয়ে দিয়ে তার স্থানে ‘মুনতাখাব’ চালু করার চেষ্টা চলছে।
চতুর্থ বিষয় হল, মাসতুরাতের পাঁচ কাজ। এভাবে প্রতিদিন নতুন নতুন ফেতনামূলক কথা ছড়িয়ে সাথীদের মানসিকতা নষ্ট করা হচ্ছে। কেউ যদি এই বিষয়গুলোকে মানতে না চায়, কোনো এলাকায় যদি এ কাজগুলো চালু না হয় তখন বলা হচ্ছে, সেখানে নিযামুদ্দিনের তরতিব চলে না। অথচ এ কাজগুলো হচ্ছে, একক ব্যক্তি মৌলভি মুহাম্মদ সাদ সাল্লামাহুর একক সিদ্ধান্তে গৃহিত তরতিব।
এই নতুন পদক্ষেপগুলোর কবলে পড়ে নিযামুদ্দিন মারকাযের পূর্বের সবগুলো মজলিস ধ্বংস হয়ে গেছে। মারকাযের ওপর এমন একদল নতুন কর্মচারী দখল করে বসেছে, যারা আমাদের বড়দের সংশ্রবপ্রাপ্ত নয়। এরাই আগত লোকদের পেছনে লেগে যায় এবং তাদেরকে এ কথা বুঝানোর চেষ্টা করে যে, ‘প্রাদেশিক যিম্মাদারদের কথা শুনো না। কারণ তারা নিযামুদ্দিন মারকাযের তরতিব মানে না।’ জামাতগুলোকেও এই হিদায়াত দিয়ে পাঠানো হচ্ছে যে, ‘এই নতুন তরতিব অনুসারে জামাত পরিচালিত করবে।’ এ কারণেই নিযামুদ্দিনে জামাত রওয়ানা হওয়ার পূর্ববর্তী হিদায়াতি বয়ান করার দায়িত্ব ও বিভিন্ন ইজতিমায় বয়ান করার দায়িত্ব এমন লোকদেরকেই দেওয়া হচ্ছে, যারা এই কথাগুলো বলবে।
এর ফলে এখন প্রতিটি প্রদেশে মতভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। জনে জনে মতভেদ হচ্ছে। নতুন সাথীরা মনে করছে যে, পুরনো লোকেরা নিযামুদ্দিনের কথা মানে না। আর পুরনো সাথীরা বিপাকে পড়ছে যে, এই নতুন নতুন বিষয়গুলো কীভাবে চালু হচ্ছে? এগুলো কখনই শূরার চূড়ান্তকৃত সিদ্ধান্ত নয়; বরং এগুলোর কারণে তাবলীগের মেহনত মূল বুনিয়াদ থেকে বিচ্যূত হচ্ছে, কাজের রুখ বদলে যাচ্ছে। সব জায়গায় ইখতিলাফ, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য চলছে। আখেরাতের ফিকির, দ্বীনের দরদ, উম্মাহর জন্যে অন্তর্জ্বালা এবং নিজের ইসলাহ ও তরবিয়তের গুরুত্ব হারাতে বসেছে; অথচ এগুলোই ছিলো এই মেহনতের প্রাণ।
সাদ এখন এমন একদল আমলার পরিবেষ্টনে আছে, যারা বড়দের সংস্পর্শ পায়নি। যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে তার প্রতিটি কথার প্রশংসা করছে। তারা তাকে এই আত্মশ্লাঘার পাত্র বানিয়ে রেখেছে যে, ‘আপনি এই মেহনত যতোটা গভীরভাবে বুঝতে পেরেছেন, পূর্ববর্তীরা ততোটা বোঝেনি এবং বর্তমান সময়ের সাথীদের মাঝেও তা বোঝার যোগ্যতা নেই।’
এই লোক যখন নিজের আবিস্কৃত নতুন বিষয়গুলো সম্পর্কে বয়ান করে তখন এ কথা বলে যে, ‘আমি তোমাদেরকে কুরআন, হাদীস ও সীরাতের আলোকে বোঝাচ্ছি। এবং এই মেহনতটিকে কুরআন, হাদীস ও সীরাতের ওপর নিয়ে আসতে চাচ্ছি।’ তার এ কথার অর্থ হলো, আমাদের আকাবির রহ. যেই কাজ করেছেন তা কুরআন, হাদীস ও সীরাত থেকে উদ্ভাবিত ছিলো না। তিনি তার বয়ানের মাঝে অবলীলায় যে কারো ওপর আঙুল তুলছেন, সমালোচনা করছেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছেন, শাসকসুলভ নির্দেশ করছেন, ইজতিহাদ করছেন, নতুন নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছেন। তার এই কর্মকা- সম্পূর্ণরূপে আমাদের আকাবির রহ. এর মানহাজের পরিপন্থী। প্রতিদিন কোনো না কোনো ফেতনামূলক কথা ছেড়ে দিচ্ছেন। যার ফলে উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দ্বীন পেরেশান ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ যে, এ-সব কী হচ্ছে? যদি এ গতিতেই ছুটতে থাকে তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন উলামায়ে কেরাম আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাবেন এবং উম্মাহর দূরদর্শী শ্রেণিও এই কাজ থেকে সরে পড়বেন।
কাজের গুরুত্ব ও এর মানহাজ হিফাযত করার জন্যে বিগত ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে দুনিয়ার সকল পুরনো সাথীদের উপস্থিতিতে হযরতজি রহ. এর শূরার সদস্যপদ পূরণ করা হয়েছিলো। সেই মজলিসে আমিও উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু তাজ্জব লাগলো, মৌলভি সাদ সাল্লামাহু সেই সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তার অস্বীকৃতির কোনো কারণ আমি দেখি না। দুনিয়ার কোনো ধর্মীয়, শিক্ষামূলক বা জাতীয় প্রতিষ্ঠান, উম্মাহর কোনো সামাজিক কাজ শূরার পৃষ্ঠপোষকতা, তত্ত্বাবধান ও পথপ্রদর্শন ব্যতিরেকে চলতে পারে না। অতীতেও চলেনি, আগামীতেও চলবে না। উম্মাহর এতো বড় কাজ কোনো এক ব্যক্তির হাতে যদি তুলে দেওয়া হয় আর সেই এক ব্যক্তি যদি এই উঁচু কাজ নিজের মর্জি মুতাবেক চালাতে শুরু করেন তাহলে মারাত্মক ও ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটবে। কারণ, কোনো ব্যক্তি নিজের মানবসুলভ দুর্বলতা ও প্রবৃত্তির প্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে নয়। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
وَمَا أُبَرِّىءُ نَفْسِي إِنَّ النَّفْسَ لأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ
‘আমি নিজেকে নির্দোষ বলি না। নিশ্চয় মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ’। [সূরা ইউসুফ : ৫৩]
সম্ভবত এ বিষয়টি সামনে রেখেই মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস সাহেব রহ. বলেছিলেন, ‘আগামীতে এই মেহনত একটি শূরার তত্ত্বাবধানে চলবে।’ (দেখুন, আখিরী মাকতুব, মাকাতিবে মাওলানা ইলিয়াস রহ.। লেখক, মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রহ.)
আমি উপর্যুক্ত কথাগুলো লিখেছি মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা ও হিসাব-নিকাশের ভয়ে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বড়দের পদ্ধতিতে কাজ করে যাওয়ার এবং নিত্য নতুন বিষয় অনুপ্রবেশ করানো থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দিন। আমীন।.
ওয়াস-সালাম
বান্দা মুহাম্মদ ইয়াকুব
আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করে দিন।
২৮ আগস্ট ২০১৬
- Comments:
- fast news day. আজকে যা যেরকম, কালকে অনেক কিছু বদলিয়ে যাচ্ছে।