সময় খারাপ: ডিসেম্বরে দেশে থাকতে চাননা ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল, অনেকেই তার পথে
================================
ইতোমধ্যে বিশ্ববাসী জেনে গেছে, বাংলাদেশের খুনি সরকারের খুন গুমের হোতাদের নাম ধাম। তাদেরই নিয়োগ করা সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক সিদ্দিক হলো দেশের গুম খুনের অন্যতম হোতা। র্যাবের কাজ করা সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল আহসান এবং জোবায়েরের মাধ্যমে এখনও গুম-খুন করিয়ে থাকেন, এবং এ সবকিছুই ’মাদার অব মাফিয়া’র জ্ঞাতসারে বা নির্দেশেই ঘটে থাকে। এনিয়ে এখন আর লুকোছাপার কিছু নাই, সবাই জানে।
তবে বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গেছে, অবৈধ সরকারের গুম খুন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে যুক্ত ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল আহসান ১ মাসের ছুটি নিয়ে শীঘ্রই জার্মানী হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন। ১ ডিসেম্বর থেকে এই বিদেশ যাত্রায় তার স্ত্রী নুসরাত জাহান এবং কন্যা তাসফিয়া আহসান জয়িতা সাথে থাকবে। সূত্রটি জানায়, জার্মানী যাওয়টা নামকা ওয়াস্তে, মুলত তার গন্তব্য নিউইয়র্ক এবং কানাডায়। তবে এই সফরে মার্কিন গ্রীণকার্ডের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবেন, তা যত দামই লাগুক না কেনো। আগামীতে দেশে দুর্দিন আসলে বাঁচার তাগিদে আশ্রয় খোঁজাই এ সফরের মূল উদ্দেশ্য, যদিও কানাডার দুর্গম শীত-বিরাণ অঞ্চলে তার সেকেন্ড হোম নেয়ার কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু ঐসব অঞ্চলে বাস করা কষ্টসাধ্য বিধায় লোকালয়ে রেসিডেন্ট চেষ্টা করা। আগেরকার মত নিউইয়র্কে গিয়ে তিনি উঠতে পারেন স্থানীয় এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর বাসায়, যিনি বিএনপির বিগত সরকারের সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের মেয়ের জামাই!
যদিও জিয়াউল সহ র্যাবের অপরাপর খুনিদের মানবতাবিরোধী অপকর্ম সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মান সরকার ওয়াকিবহাল আছে, তদুপরি অনলাইনে তাদের যেসব ফিরিস্তি রয়েছে:
১) বিএ-৪০৬০ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান (জন্ম তারিখ ১ জানুয়ারি ১৯৭১) ২৪তম লংকোর্সে ১৯৯১ সালে (তখন বিএনপি ক্ষমতায়) পদাতিক শাখায় সেনাবাহিনীর চাকুরিতে যোগ দেন। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর ২৭ আগস্ট লে. কর্নেল জিয়াউল আহসানকে র্যাবে পরিচালক হিসাবে নিয়োগ করে। প্রথমে গোয়েন্দা শাখার পরিচালক এবং পরে ২০১৩ সালে হেফাজত নিধনের পুরষ্কার স্বরূপ পদোন্নতি দিয়ে সংস্থাটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক করা হয়। এসব পদে থেকে বিনাভোটের সরকারের ইচ্ছায় বিরোধী দল নিধনে ব্যাপক তৎপরতা চালান। তার কাজে খুশী হয়ে সরকার তাকে দু’টি পদোন্নতি দিয়ে কর্নেল এবং ব্রিগেডিয়ার করে। বর্তমান পোস্টিং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (NTMC) পরিচালক, যাদের কাজ মুলত নাগরিকদের ও বিশিষ্টজনদের ফোনে আড়িপাতা এবং কথপোকথন রেকর্ড করা।
২) ব্রিগেডিয়ার জিয়াউলের বিরুদ্ধে হাজার খানেক বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ গুম ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে। নিহতরা মূলত সরকারবিরোধিতার কারনে এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
৩) ২০১০ সালের ২৫ জুন বিএনপির ঢাকা মহানগরের প্রভাবশালী নেতা সহসভাপতি ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের রমনা-শাহবাগ এলাকার সাবেক কমিশনার চৌধুরী আলমকে তার বাসার সামনে থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় র্যাব। এরপর আর তার খোঁজ মিলেনি। শোনা যায় তাকে হত্যা করে মেঘনায় ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে লাশ, ঐ ঘটনার সাথেও জড়িত ছিল লে.কর্নেল জিয়া।
৪) ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে কর্নেল জিয়ার নেতৃত্বে গুম করা হয়। অনেকে বলে থাকেন জিয়া নিজেই গুলি করে তাকে হত্যা করেছে ঘটনার রাতেই। যদিও হত্যার তথ্যটি প্রমানিত নয়। কারো কারো মতে তাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
৫) ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল আশুলিয়া থেকে নিখোঁজ হওয়ার পরদিন ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায় গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের। ঐ হত্যার সাথে তিনি জড়িত এমন কথা প্রচার আছে। এ নিয়ে বিস্তর প্রতিবাদ আন্দোলন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রশ্নের মুখে পড়েছিল সরকার, কিন্তু কোনো সঠিক জবাব দিতে পারেনি। পরে একটা নামকা ওয়াস্তে বিচার দেখানো হয়েছে।
৬) ২০১৫ সালের মার্চে বিরোধীদলীয় মুখপাত্র হিসাবে পরিচিত বিএনপির সাবেক মন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদকে তার বাসা হতে র্যাব অপহরণ করে গুম করে। ঘটনাটি দেশে এবং বিদেশে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং দেশি ও বিদেশী গণমাধ্যমে এটি নিয়ে সংবাদ প্রচার হয়। ঐ গুম ও অপহরণের সাথে জিয়া জড়িত ছিল।
৭) র্যাবের এডিজি হিসাবে কর্নেল জিয়াউল হাসানের নির্দেশ ও শলাপরামর্শেই ২০১৪ সালের এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডার সংঘঠিত করে র্যাব-১১ সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ (আওয়ামীলীগের তৎকালীন ত্রাণমন্ত্রী মায়ার মেয়ের জামাই)। খবরে প্রকাশ, নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তার সহযোগীদের কাছ থেকে ৬০ কোটি টাকার বিনিময়ে কাউন্সিলর নজরুলকে অপহরণ করে হত্যা করে র্যাবের কর্মীরা। সেনানিবাসের বাসভবন ‘আশালতা’র নিচে দাঁড়িয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদকে অপারেশনটি করার জন্য শলাপরামর্শ ও নির্দেশ প্রদান করেন কর্নেল জিয়া, এমন খবর তদন্তে উঠে আসে। এমনকি কাউন্সিলর নূর হোসেনকেও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল, কিন্তু ভারতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পায়।
৮) ২০১৩ সালের ৫মে শাপলা চত্তরে সংঘটিত গণহত্যার অন্যতম অপারেশন ইনচার্জ ছিলেন র্যাবের পরিচালক লে. কর্নেল জিয়া, টেলিভিশন সাক্ষাতকারে তিনি তা স্বীকার করেছেন। এর কয়দিন পরেই তাকে বিশেষ ব্যবস্থায় কর্নেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।
৯) ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর লাকসামের বিএনপি সভাপতি সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও লাকসাম শহর বিএনপি সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজকে মোবাইল ট্র্যাকিং করে আটক করে র্যাবের-১১-এর সিও লে. কর্নেল তারেক সাইদের টিম দিয়ে হত্যা করা হয়। ঐ ঘটনার সাথেও জড়িত ছিল জিয়া।
১০) সৌদি কূটনীতিক খালাফ আলির খুন, সাংবাদিক জুটি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির হত্যাকান্ডের সাথে তার জড়িত থাকার কথা শোনা যায়।
১১) ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি বানচাল করতে এবং ঐ সময়ে বিরোধী দল নিধনের মূল পরিচালক ছিল কর্নেল জিয়া। ঐ সময় কয়েক’শ বিএনপি ও ছাত্রদল নেতাকে অপহরণ করে গুম করা হয়। এদর মধ্যে রয়েছে তেজগাঁও থানা ছাত্রদলের যুগ্মসম্পাদক তরিকুল ইসলাম ঝন্টু, এয়ারপোর্ট থানা ছাত্রদল সেক্রেটারি নিজামউদ্দিন আহমেদ মুন্না, ৩৮ নং ওয়ার্ড বিএনপি সেক্রেটারী সাজেদুল ইসলাম সুমন ও কর্মী তানভীর,, বংশাল ছাত্রদল সেক্রেটারি পারভেজ হোসেন, বংশাল থানা ছাত্রদল আহবায়ক মো. জহির, পল্লবী থানা ছাত্রদল জয়েন্ট সেক্রেটারি তরিকুল ইসলাম, সুত্রাপুর স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মাসুদ রানা, তেজগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা কাওসার, দারুস সালাম ছাত্রদল ভাইস প্রেসিডেন্ট মফিজুল ইসলাম রাশেদ, তেঁজগাও থানা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা এ এ ম আদনান চৌধুরি, সুত্রাপুর থানা ছাত্রদল সভাপতি মো. সেলিম রেজা পিন্টু ও জয়েন্ট সেক্রেটারি সম্রাট মোল্লা, নেতা খালেদ হাসান সোহেল, সবুজবাগ থানা ছাত্রদল সভাপতি মাহাবুব হাসান সুজন ও ৫ নং ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি কাজী ফরহাদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল নেতা মাযহারুল ইসলাম রাসেল, আল আমিন, আসাদুজ্জামান রানা, বংশাল থানা ছাত্রদল নেতা মো. চঞ্চল প্রমুখ। এখনও তাদের পরিবার ও স্বজনরা অপেক্ষা করে আছে!
১০) ২০১৪ সালের একদলীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ মধ্যরাতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল এরশাদকে তুলে নিয়ে যায় র্যাবের কর্নেল জিয়ার দল, এবং ডিজিএফআই প্রধান মেজর জেনারেল আকবরের সামনে হাজির করে। তাকে ইলেকশনে অংশ নেয়ার জন্য চাপ দেয়া হয়। কিন্তু রাজী না হওয়ায় জেনারেল এরশাদকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। পরে তাকে মাসাধিক কাল সিএমএইচে আটকে রেখে নির্বাচনী নাটক সম্পন্ন করা হয়।
র্যাবে থাকতে জিয়াউল আহসানের গুম ও খুনের কাহিনী নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক লেখালেখি হয়, ফলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার তারে র্যাব থেকে সরিয়ে প্রথমে ডিজিএফআইতে বদলী করা হয়, পরে ২০১৬ সালে এনএসআইতে দেয়া হয়, এবং সর্বশেষে ২০১৭ সালে বসানো হয় টেলিফোন আড়িপাতা সংস্খা এনটিএমসির পরিচালক হিসাবে।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় খুম, গুম, অপহরণের সাথে জড়িত জিয়াউল আহসান এবং অন্যান্যদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলি বেশ ভালোভাবে অবহিত আছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম আর নির্যাতনের অভিযোগে র্যাবের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে গত মাসের শেষ দিকে ট্রাম্প প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছেন মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির ১০ সদস্য। মার্কিন সিনেটে ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটর বব মেনেনডেজ ও রিপাবলিকান পার্টির সিনেটর টড ইয়াং এবং তাঁদের আট সিনেট সহকর্মী গত মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং অর্থমন্ত্রী স্টিভেন মানুচিনকে অনুরোধ করেছেন। এছাড়াও প্রবাসী বাংলাদেশীরাও বিষয়টি নিয়ে সচেতন আছেন।
23-Nov-2020 11:23 am