প্রসঙ্গ : চেয়ারে বসে নামাজ পড়া।
এই ব্যপারে ফতোয়া চাওয়া হয়েছিলো দেওবন্দ মাদ্রাসায়।
ইফতাহ বিভাগের পক্ষ থেকে উত্তর দেন মুফতি যাইনুল ইসলাম কাসেমী।
কয়েক পৃষ্ঠার এই ফতোয়া তাদের ওয়েব সাইটে উর্দুতে প্রকাশিত হয়।
এটা বাংলা অনুবাদ করেছেন মুফতি এনামুল হক কাসেমী।
আর বাংলা অনুবাদটা প্রকাশিত হয়েছে মাসিক আল আবরার পত্রিকায়।
নিচে ফতোয়া। Collected.
_____
দাঁড়াতে ও সিজদা করতে সক্ষম এমন ব্যক্তির জন্য নামাজে কিয়াম বা দাঁড়ানো ফরজ এবং এটি নামাজের একটি রুকন। যদি দাঁড়ানো বা সিজদাদানে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ফরজ নামাজ বসে আদায় করা হয়, তবে নামাজের ফরজ বা রুকন ছেড়ে দেওয়ার কারণে নামাজ হবে না। নামাজ পুনরায় পড়তে হবে। (দুররে মুখতার, যাকারিয়া বুক ডিপো ২/১৩২)
এমনকি যদি নামাজের কিছু অংশ দাঁড়াতে সক্ষম, পুরো সময় দাঁড়িয়ে থাকতে অপারগ, তবে যেটুকু সময় দাঁড়াতে পারবে তা কোনো লাঠি বা দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে হলেও সেটুকু দাঁড়ানো ফরজ। এমতাবস্থায় যদি না দাঁড়ায় এবং কোনো কিছুর ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়ানোর পরিবর্তে বসেই নামাজ আদায় করে, তবে নামাজ হবে না। (দুররে মুখতার ২/২৬৭)
যদি কোনো লোক দাঁড়াতে সক্ষম, কিন্তু রুকু-সিজদা বা শুধু সিজদা করতে সক্ষম নয়, তার জন্য বসে নামাজ আদায় করা জায়েজ। সে ইশারার মাধ্যমে রুকু-সিজদা করবে। এমতাবস্থায় দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করার চেয়ে বসে ইশারার মাধ্যমে নামাজ আদায় করা উত্তম। (দুররে মুখতার ২/৫৬৭), ফতোয়া আলমগীরী ১/১৩৬-তেও এরূপ রয়েছে।
যেসব অক্ষমতার কারণে দাঁড়ানোর আবশ্যিকতা রহিত হয়ে যায়, তা দুই প্রকার :
১। হাকিকি বা মৌলিক : এমন অক্ষম, যে দাঁড়াতে পারবে না।
২। হুকমি বা বিধানগত : এমন অক্ষম নয় যে, দাঁড়ানো সম্ভব না, বরং দাঁড়ালে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অথবা এমন দুর্বলতা থাকে, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে অক্ষমতা বলে বিবেচিত, যেমন অসুস্থতা, যার ব্যাপারে অভিজ্ঞ মুসলিম ডাক্তাররা পরামর্শ দেন যে দাঁড়ালে রোগ বৃদ্ধি পাবে অথবা সুস্থতা ফিরে আসতে বিলম্ব হবে কিংবা দাঁড়ানোর কারণে অসহনীয় ব্যথা অনুভূত হয়, এসব অবস্থায় বসে নামাজ আদায় করা জায়েজ। (দুররে মুখতার মাআ রদ্দুল মুহতার ২/৫৬৫)
যদি অসহনীয় ও অস্বাভাবিক ব্যথা না হয়, বরং সামান্য ব্যথা অনুভব হয়, তবে তা শরিয়তের দৃষ্টিতে অক্ষমতা বলে বিবেচিত হবে না। এমতাবস্থায় বসে নামাজ আদায় করা জায়েজ নেই। (তাতারখানিয়া-যাকারিয়া বুক ডিপো-২/৬৬৭)
যে লোক দাঁড়াতে অক্ষম, কিন্তু মাটিতে বসে সিজদার সঙ্গে নামাজ আদায় করতে সক্ষম, তবে তাকে মাটিতে বসে সিজদাসহকারে নামাজ আদায় করতে হবে। মাটিতে সিজদা না করে চেয়ারের ওপর বসে বা মাটিতে বসে ইশারা করে নামাজ আদায় করা জায়েজ হবে না। (তাতারখানিয়া-যাকারিয়া বুক ডিপো-২/৬৬৭)
যদি রুকু ও সিজদা করতে অপারগ, কিন্তু মাটিতে বসে ইশারা করে নামাজ আদায় করতে সক্ষম, তবে তাশাহুদ অবস্থার মতো বসা আবশ্যক নয়। বরং যেকোনোভাবেই চাই মহিলাদের তাশাহুদে বসার মতো বা যে আসনে বসলে আরাম হয়, সেভাবেই মাটিতে বসে ইশারা করে নামাজ আদায় করবে। চেয়ারে বসা উচিত নয়। কারণ শরিয়ত এমন অপরাগদের মাটিতে বসার ব্যাপারে পূর্ণ ছাড় দিয়েছে, যে আসনে সম্ভব হয়, সেভাবেই বসে নামাজ আদায় করবে। (দুররে মুখতার মাআ শামী-২/৫৬৬)
এমতাবস্থায় প্রয়োজন ছাড়া চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করলে কয়েকটি কারণে মাকরুহ হবে।
১. মাটিতে বসা সুন্নাত। এ পদ্ধতিতেই সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তী মুসলমানদের আমল চলে আসছে। ৯০ দশকের আগ পর্যন্ত চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করার প্রচলন ছিল না। খাইরুল কুরুন তথা ইসলামের সোনালি যুগেও এর কোনো নজির পাওয়া যায় না।
২. চেয়ার ব্যবহারের কারণে নামাজের কাতারে অনেক ফাঁকা রয়ে যায়। অথচ এত্তেসালে সফ তথা কাতারে পরস্পর মিলে দাঁড়ানোর ব্যাপারে হাদিসে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
৩. প্রয়োজন ছাড়া চেয়ার মসজিদে নেওয়ার কারণে বিধর্মীদের উপাসনালয়ের সাদৃশ্যতা দেখা দেয় অথচ দ্বীনি কাজে অন্যদের সাদৃশ্য গ্রহণ নিষেধ।
৪. নামাজ হলো বিনয় ও নম্রতার বহিঃপ্রকাশ, প্রয়োজন ছাড়া চেয়ার ব্যবহার করার চেয়ে মাটিতে নামাজ আদায় করলে বিনয় ও নম্রতা পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পায়।
৫. মাটির নিকটবর্তী হওয়া নামাজের একটি কাম্য বিষয়, যা চেয়ারের ওপর আদায় করলে পাওয়া যায় না।
যদি কোনোভাবেই মাটিতে বসে নামাজ আদায় করার সাধ্য ও সামর্থ্য না থাকে, তবে প্রয়োজনের ভিত্তিতে চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করা যাবে। কিন্তু যদি যেকোনোভাবে মাটিতে বসে রুকু-সিজদা করার সামর্থ্য থাকে, তবে চেয়ারে নামাজ আদায় করা জায়েজ হবে না।
যে ক্ষেত্রে জরুরতের কারণে চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করার অনুমতি রয়েছে, সে ক্ষেত্রে সিজদার সময় ইশারার ওপরই ক্ষান্ত হওয়া উচিত। চেয়ারের কোনো অংশ যেমন কোনো কাঠের ওপর সিজদা করার তথা অক্ষম অবস্থায় কোনো উঁচু বস্তুর ওপর সিজদা করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। যেমন একদিন নবী করিম (সা.) কোনো সাহাবির শুশ্রূষা করতে তাশরিফ নিয়ে গেলেন। ওই সাহাবি অক্ষমতার কারণে একটি বালিশের ওপর সিজদা আদায় করছিলেন। নবী করিম (সা.) তাঁকে সেরূপ করা থেকে বারণ করতে গিয়ে বলেছেন, যদি মাটিতে সিজদা করা তোমার জন্য অসম্ভব হয়, তবে ইশারা করে নামাজ আদায় করবে এবং সিজদার মধ্যে রুকু অপেক্ষা সামান্য বেশি ঝুঁকবে। এ হাদিসটি মুসনাদে বাযযারে বর্ণিত। এর বর্ণনাকারীরা সহিহ হাদিসের বর্ণনাকারী। (এ’লাউস-সুনান- ৭/১৭৮)
আরেক বর্ণনায় আছে, উম্মুল মুমিনীন হজরত উম্মে সালমা (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর সামনে একটি বালিশ আনা হলো। এর ওপর তিনি সিজদা করতেন। নবী করিম (সা.) এটি দেখেছেন, কিন্তু নিষেধ করেননি। নবী করিম (সা.) কর্তৃক কোনো আমল দেখে চুপ থাকাটা অনুমতির প্রমাণ বহন করে।
আল্লামা শামী (রহ.) উভয় বর্ণনার মধ্যে এভাবে সামঞ্জস্য বর্ণনা করেছেন, নামাজ আদায়কালে কোনো বস্তু উঠিয়ে তার ওপর সিজদা করা মাকরুহ। কিন্তু যদি মাটিতে আগে থেকে কোনো বস্তু স্থাপিত থাকে এবং নামাজ আদায়কারী এর ওপর সিজদা করে, তবে তা মাকরুহ হবে না।
ওই আলোচনার সার কথা হলো, কোনো পূর্ব স্থাপিত উঁচু বস্তুর ওপর সিজদা করা অথবা সিজদার জন্য কোনো বস্তু রাখা ছাড়া ইশারা করে নামাজ আদায় করা উভয়টিই জায়েজ। কিন্তু উল্লিখিত টেবিলসংযুক্ত চেয়ারে সিজদা করলে তাও মূল সিজদা হবে না, বরং ইশারার মতোই হবে। সুতরাং সেরূপ কুরসির ওপর বসে নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি যদি ইমামতি করে, তবে তার পেছনে রুকু-সিজদাকারী মুসল্লির নামাজ হবে না।
আল্লামা শামী (রহ.) লিখেন : কিন্তু নবী করিম (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরাম বারণ করার কারণে তা (উঁচু বস্তুতে সিজদা করা) অনুত্তম বলেই মনে হয়। তা ছাড়া যারা নিয়মিত চেয়ার বা কুরসিতে নামাজ আদায় করে থাকে, তাদের সব সময় নামাজে অসম্পূর্ণতা অনুভূত হবে। অর্থাৎ এরূপ সন্দেহ হবে যে আমরা তো সিজদাই করলাম না আমাদের নামাজ হচ্ছে কি না?
হজরত হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) একে অনুত্তম বলেন : সিজদা করার জন্য বালিশ বা কিছু উঁচু বস্তু রেখে দেওয়া এবং এর ওপর সিজদা করা উত্তম নয়। যখন সিজদা করতে অপারগ হবে, তখন ইশারা করেই নামাজ আদায় করবে। বালিশ বা উঁচু কিছুর ওপর সিজদা করার প্রয়োজন নেই। (বেহেশতী জেওর ২/৪৫, অসুস্থ ব্যক্তির নামাজের বর্ণনা)
উল্লিখিত দীর্ঘ আলোচনার সংক্ষিপ্ত নিম্নরূপ :
১. যে ব্যক্তি দাঁড়াতে সক্ষম নয়, কিন্তু যেকোনোরূপে মাটিতে বসে রুকু-সিজদা করে নামাজ আদায় করতে পারে, তাকে মাটিতে বসেই রুকু-সিজদা করে নামাজ আদায় করতে হবে। চেয়ার ইত্যাদিতে বসে ইশারায় রুকু-সিজদা করে নামাজ আদায় করা জায়েজ হবে না। নামাজ আদায় হবে না।
২. যদি দাঁড়াতে পারে, কিন্তু কোমর বা হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা হওয়ার কারণে সিজদা করার শক্তি নেই অথবা ওই ব্যক্তি যে মাটিতে বসতে পারে কিন্তু রুকু-সিজদার শক্তি রাখে না, এরূপ লোক জমিতে বসে নামাজ আদায় করবে। চেয়ার ইত্যাদির ব্যবহার মাকরুহ হবে। হ্যাঁ, যদি কোনোভাবেই মাটিতে বসা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে, তখন চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করা যেতে পারে। এমতাবস্থায় চেয়ার ব্যবহার করলেও সাদামাটা চেয়ার ব্যবহার করবে। টেবিলযুক্ত চেয়ার ব্যবহার করবে না।
মাটিতে বা চেয়ারে নামাজ আদায় করার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য :
১. চেয়ারে ইশারা করে নামাজ পড়ার সময় অনেকে রুকুতে হাত রানের ওপর রাখে এবং সিজদার সময় শূন্যে আলগে ধরে সিজদার ইশারা করে। এরূপ করা স্বীকৃত নয়। রুকু ও সিজদা উভয় ক্ষেত্রে হাত রানের ওপর রাখা উচিত।
২. অক্ষম অবস্থায় মাটিতে বসে রুকু-সিজদার সঙ্গে নামাজ আদায় করার ক্ষেত্রে রুকুতে নিতম্ব মাটি থেকে ওঠানোর প্রয়োজন নেই। বরং কপাল হাঁটু বরাবর হওয়া জরুরি। “বসা অবস্থায় রুকু করার সময় শুধু কপালকে হাঁটু বরাবর করা জরুরি। এর চেয়ে বেশি ঝোঁকার প্রয়োজন নেই। না নিতম্ব ওঠানোর প্রয়োজন আছে। (এমদাদুল আহকাম : ১/৬০৯)
চেয়ারে নামাজ আদায়কারীরা এখন নিজের অবস্থার ওপর চিন্তা করে দেখুন। বাস্তবে কি আপনি এমন অক্ষম যে, শরিয়তের দৃষ্টিতে আপনার জন্য চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করা জায়েজ হবে। বাস্তবে আপনি সেরূপ অক্ষম ও অপারগ না হলে চেয়ারে নামাজ আদায় পরিহার করতে হবে। যাতে আপনার নামাজ শরিয়ত অনুযায়ী হয়। মসজিদে প্রয়োজন ছাড়া চেয়ারের আধিক্য না হয়, মসজিদকে কোনো কনভেশন সেন্টার বা বিয়েবাড়ি বা হল মনে না হয়। আর একান্ত প্রয়োজনে যদি চেয়ার ব্যবহার করতেই হয়, তবে টেবিলযুক্ত চেয়ার যেন ব্যবহার না করা হয়।